দিলরুবা
সারাজীবন ভোগ পেরিয়ে পড়ে থাকে অনন্ত ভোগান্তি। কত বিদগ্ধ কাহিনি স্মৃতি হয়ে ছলকে ওঠে। রোদের নদীর মতো চলকে ওঠে সেসব কথনছবি। হাওয়া নড়ে, হাওয়ার ভেতর ভেসে ওঠে বিষণ্ণ অতীত।
তখন আমার পুঁচকেবেলা পেরিয়ে স্কুলবেলা। পাখি প্রজাপতি ফড়িং পোকামাকড় জীবজন্তু নিয়ে খুনসুটি। খেলাধুলো সাঁতার বালকবেলার সকলের।
যথারীতি ধর্মখেকোদের কারসাজিতে দু-বাংলা ফাঁক হলে, হিন্দু হবার অপরাধে অপমান সইতে না-পেরে আমরা এপার বাংলায়। ওপারের মোল্লাদের বিধান ডাক্তারবাবু, 'অনে দেশ ছাড়ি ভারতে চলি যানগই।' সিদ্দিক মিঞা প্রতিবাদ জানালে মোল্লারা রে-রে করে ওঠে 'এই শালা ডেঁডার (হিন্দুর) দালাল, কিরিচ দিয়েনে এককোপে কল্লা কাটিয়েনে ধড়-মুণ্ডু ফাঁক করি দিয়ম।' তারপর আজ এখানে কাল সেখানে টানাপোড়েনে কলকাতার যাদবপুরে বসত।
কলোনি-সংস্কৃতিতে রোদ-জ্যোৎস্না মশকরা দেয় আমাদের টিনের ঘরে। চোখেমুখে ঢোকে শীত। ঝড় এলে ঘর নড়ে। ওপার বাংলায় আমাদের সমগ্ৰজুড়ে নাচত ভাত। বাবা চিকিৎসক হলেও এখন একটামাত্র রোজগার, অনেক হা-পিত্যেশ খিদে।
কাঁচা বাড়ি থেকে ডাঙ্গা-দহলা পেরিয়ে নেমে এসেছে একটা পায়ে হাঁটা পথ। পথের দু-ধার সাধ-সাযুজ্যে গড়ে ওঠেছে টিনের-টালির-খড়ের ছাউনি মাথায় নিয়ে সূর্য ঢাকার আচ্ছাদন।দিনে দিনে জেগে ওঠে জীবন। বৃষ্টিরাতে ঝলকানো চমক ছাড়া বিদ্যুৎ দেখিনি কেউ। সাঁঝ নামলেই পুকুরের দিকে ঝোঁকা জাম কেমন ঝিম ধরে বুড়ো ভাম। দিঘি থেকে ওঠে আসে ডাকাবুকো অন্ধকার আর ওপাশে শেয়ালের হাঁক।
তারপর প্রতিসন্ধেয় বেশ খেলা দেয় কে বা কারা, বাঁশ ডগায় কন্দ খেলে __ ঝমরঝম ঢিল ফেলে আমাদের টিনের চালে । সঙ্গে অলিগলিতে তাফাল কুকুরের চিৎকার। ঢিল-বৃষ্টিতে আমরা কেমন অসহায় জবুথবু হয়ে বোবাভয়ে বিষণ্ণ গিলতাম।
বাবা বলতেন, এসব নিয়ে তোর ঘর-দোর! সম্পর্ক রাখিস কেন এসব বেয়াদব বদতমিজদের সাথে!
প্রতিসন্ধেয় ক্লেদ মেখে দিনের আলোয় বন্ধুরা বাঁকা তাকায়। অসীম বলে, 'পাহারা দিয়ে ধরলেই পারিস কারা এই অনিষ্ট করছে। তুই একটা আস্ত ইয়ে।' পাড়া পেছনে ঘেউ দেয়। প্রতিপৃষ্ঠায় ওদের তাচ্ছিল্যের হাসি। কারা যে পাঁচরকম ছুরি শানায়! কে ওড়ায় এমন শয়তানি তক্কে তক্কে পাহারা দিয়েও এঁটে ওঠতে পারি না । ভূতুড়ে জ্যোৎস্নায়ও নেচে ওঠে পাথরবৃষ্টি। ঘাসের রক্তপাতে লাল হয় প্রত্যহ মাটি।
চিরদিন পাপোশ থাকব নাকি ধুলো হয়ে? ডিঙোতে হবে আগুন । পায়রা ঠিক আকাশ ছেনে জেনে নেয় আলো। ভাঙা নৌকা নিয়ে ঢেউ ভাঙতে ভাঙতেই এগুতে হবে। দিনবদলের রং লেগে থাকে দিনগুজরানের মধ্যেই। মনে মনে ছকে ফেলি কিশোরবেলার কেরামতি।
নির্জন ওড়ছে। ঘুঘু ডেকে চলেছে। কুবোর নিরবচ্ছিন্ন কুব কুব। বাসন-দুপুরে পাড়া তখন ভাত-ঘুমে ঢুলু ঢুলু। সূর্যের দাঁত খাচ্ছে মাটি-জল। দূরে পিচরাস্তা থমথমে রোদে পুড়ে খাক । রাস্তার জিভে মানুষের রক্তের স্বাদ। মাঝেমধ্যে বুনো ক্ষ্যাপা বাতাস ঢেউ তুলছে। আমি আর সহপাঠী দিলীপ তখন এলোমেলো পাথর জড়ো করছি গাছ-ছায়ায়। টুকুস-টুকুস পাথর ভাঙার শব্দে পাড়া নড়েচড়ে ওঠে খানিক। টের পেয়ে যান বাবা -মা আমাদের স্কুল কামাই । মা শোর তোলেন, 'ইস্কুলে যাসনি।' বাবা তেড়ে আসেন, 'কী ভেবেছ তুমি, বখাটের সাথে দিন যাবে? এই দিলীপ, তোর স্কুল নেই?' দিলীপ কাঁচুমাচু,' না মানে ....।' আমি শুধু করজোড়ে অপরাধ স্বীকার করে সন্ধে পর্যন্ত তাঁদের কাছে নিস্তার চাই।
তারপর সূর্যাস্ত টের পেতেই আমাদের টিনের চালে পাথর-বৃষ্টির আগেই আমার আর দিলীপের হাতের
মুদ্রায় বেজে ওঠে লক্ষ লক্ষ দিলরুবা। গাছের পাখিরা কঁকিয়ে ওঠে। অলিগলিতে কুকুরের ঘেউ, শেয়ালের হুক্কারব। ঢিল ছোঁড়া দূরত্বের সমস্ত টিনের চাল তখন আমাদের পাথরবৃষ্টির কাহারবা আর দাদরা বেজে যাচ্ছে নিরন্তর। জেগে ওঠেছে পাড়া তখন।
আমাদের টিনের চাল স্বস্তি ফিরে পায়। আর কোনোদিন পাথরের ধারাপাত হয়নি ।
Comments