পানাজির ‘ছোটো পর্তুগাল’-এ
মূল সড়ক ছেড়ে বাঁ দিকে ঘুরতেই মনে হল যেন সম্পূর্ণ অন্য একটা জগতে এসে পড়লাম। সরু রাস্তাটার দু’ধারে অন্য রকম স্থাপত্য। আর পাঁচটা বাড়ির থেকে একদমই আলাদা। উজ্জ্বল রঙা এই বাড়িগুলো মোটামুটি দু’তলাবিশিষ্ট। কারও রঙ হলুদ, কেউ সেজেছে আকাশি-নীল রঙে, কেউ বা খয়েরি।
এই রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভুলে যাবেন আপনি কোথায়। দৈনন্দিন ব্যস্ততার থেকে কিছুটা দূরে এই পাড়া মনে করাবে আপনি ইউরোপের কোনো শহরে এখন। বাড়িগুলোর স্থাপত্যে পর্তুগিজ ছাপ স্পষ্ট। হাঁটতে হাঁটতে যখন মোহিত হয়ে যাবেন, তখনই বাইক বা স্কুটারের হর্নের শব্দে আপনার সম্বিৎ ফিরবে। আপনি খেয়াল করবেন, না ইউরোপের কোনো দেশে নয়, ভারতেই রয়েছেন।
গোয়ার রাজধানী পানাজি শহরের ফোনটেনহাস পাড়াটি আপনাকে ইউরোপে পৌঁছে দেবেই। মনে হবে আপনি যেন পর্তুগালে এসে পড়েছেন হঠাৎ করে। ঠিক যেমন আমাকেও দিয়েছিল। এখানে দেড় ঘণ্টা সময় কাটানোর পরেও মনে হচ্ছিল আরও বেশ খানিকক্ষণ কাটাতে পারলে ভালো হত।
গোয়ার মধ্যেই রয়েছে আরও একটা গোয়া। ছবির মতো সুন্দর সৈকত, পার্টি, হুল্লোড়, দেদার খানাপিনার গোয়ার আড়ালে এই গোয়া যেন পড়ে রয়েছে দুয়োরানির মতো। এখানে খুব বেশি পর্যটকের পা পড়ে না। জাঁকজমকের আড়ালে থাকা এই পাড়ায় আসতে হলে গোয়ার ইতিহাসটাও জানতে হবে।
১৫১০ সালে বিজাপুরের সুলতানদের হাত থেকে গোয়ার ক্ষমতা দখল করে নেয় পর্তুগিজরা। ছোট্ট এই রাজ্যটায় শুরু হয়ে যায় পর্তুগিজদের প্রভাব। দাপট এতটাই বেশি ছিল যে ব্রিটিশরা এখানে কোনো ভাবেই
নাক গলাতে পারেনি। সেই কারণে গোয়ায় আজও অনেক ক্ষেত্রেই পর্তুগিজ প্রভাব দেখা যায়।
প্রথম দিকে গোয়ার রাজধানী ছিল ওল্ড গোয়ার ভেলহা শহর। এই ওল্ড গোয়ায় রয়েছে বিখ্যাত কিছু স্থাপত্য – সে ক্যাথেড্রাল, বম জেসাস বেসিলিকা এবং সেন্ট আগস্টাইন চার্চের ধ্বংসাবশেষ।
পানাজির এই ফোনটেনহাস পাড়াটি গড়ে ওঠে উনিশ শতকের মাঝামাঝি। ওল্ড গোয়া থেকে পানাজি শহরে রাজধানী সরিয়ে আনেন গোয়ার শাসকরা। এই পাড়ায় গড়ে ওঠে তাঁদের আবাসিক এলাকা। তবে কোনো রকম পরিকল্পনা ছাড়াই এই ফোনটেনহাস গড়ে উঠেছিল। সেই কারণে এই সরু গলি আজও এই পাড়ার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অনেকটা উত্তর কলকাতার গলিগুলোর মতো। তবে পরিচ্ছন্ন।
পুর্বে কেরিম ক্রিক এবং পশ্চিমে আন্তোনিও পাহাড়ের ঠিক মাঝেই অবস্থিত পানাজির ঐতিহ্যশালী এই এলাকাটি। এখানকার বাড়িগুলোর নম্বরপ্লেটেও শৈল্পিক ছাপ স্পষ্ট। বাড়ির স্থাপত্যশৈলী আপনাকে সুন্দর একটা অনুভূতি দেবে। এই পাড়া যেন ছবি-শিকারিদের স্বর্গরাজ্য।
ফোনটেনহাসের সরু রাস্তাগুলোর নামকরণেও কী বৈচিত্র্য। একটি রাস্তার নাম, ‘রুয়া ৩১ দে জেনেইরো’। এর অর্থ ৩১ জানুয়ারি সরণি। ১৬৪০ সালে ৩১ জানুয়ারি স্পেনের হাত থেকে স্বাধীন হয়েছিল পর্তুগাল। আবার অন্য একটি রাস্তার নাম, ‘১৮ জুন রোড’। গোয়াকে পর্তুগালের হাত থেকে স্বাধীন করার জন্য এই তারিখেই আন্দোলন শুরু করেছিলেন রামমনোহর লোহিয়া। সব মিলিয়ে এই পাড়ার প্রতিটি বাড়িতে, গলিঘুঁজিতে লুকিয়ে রয়েছে ইতিহাস।
বর্ষায় গোয়ার সৌন্দর্য অন্য রকম। বর্ষার গোয়া মানে অঝোরধারায় বৃষ্টি, ছাতাতেও যা মাঝেমধ্যে বাঁধ মানে না। সেই বৃষ্টিকে উপেক্ষা করেই বেরিয়ে পড়া। বৃষ্টিকে থোড়াই কেয়ার করে কাকভেজা হয়ে যাওয়া। বর্ষার গোয়া মানে চারিদিক সবুজ, যা এক দিকে যেমন চোখের আরাম অন্য দিকে মনেরও শান্তি।
বর্ষার এই গোয়াতেই ফোনটেনহাসের বৃষ্টিমাখা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার মধ্যে একটা অন্য রকম অনুভূতি রয়েছে। অন্য রকম মাদকতা রয়েছে। এই মাদকতা কিন্তু সহজে আপনার কাছে আসবে না। একে খুঁজতে হবে।
তাই গোয়া বেড়াতে এলে জাঁকজমকপূর্ণ জিনিসগুলো কিছুটা সরিয়ে রেখে একবার অন্তত চলে আসুন এই ফোনটেনহাসে। ইতিহাসের সঙ্গে গা মাখামাখি করুন। সুন্দর একটা অভিজ্ঞতার সাক্ষী থাকুন।
Comments